বাজারে পতন দুঃখজনক হলেও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও ট্রেড ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
আগে বাজার বাড়লে মোটামুটি সবার কম বেশী লাভ হত। একটা কথা প্রচলিত আছে - Bull market is a market when everybody believes that he/ she is a financial genius.
আর এখন ফিউচার অপশনের রমরমার যুগে শেয়ার বাজার পড়লে লোকসান, বাড়লেও লোকসান। কোনোদিকে যাবার জায়গা নেই।
রিটেল ট্রেডরদের জন্য সুইং ট্রেডিং সবচেয়ে প্রশস্থ পথ। সুইং ট্রেডারদের রিস্ক ম্যানেজমেন্টের পদ্ধতি নিয়ে এই আলোচনা।
রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি যে স্টপ লস রেখে তাড়াতাড়ি লস বুক করতে হবে আর প্রফিটকে বাড়তে দিতে হবে। সবাই জেনে বুঝেও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করে উঠতে পারি না। তবে ঘটনা যে এটা দুনিয়ার কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সমস্যা হল এটা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই। এই কৌশল আয়ত্ত না করতে পারলে একজন সফল ট্রেডার হওয়া যাবে না।
শেয়ার বাজারে ট্রেডিং করার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বাজার তথা ট্রেডারদের মনস্তত্ত্ব বিষয়ক বিভিন্ন বই পড়ে বুঝতে পেরেছি এখানে নিজের ঘুঁটি নিজেকেই সাজাতে হয়। পড়াশোনা এবং শেখার মাধ্যমে একটা পর্যায়ে পৌঁছান যায় বটে কিন্তু জিগ-স-পাজেলের মতন টুকরো টুকরো অংশ সাজিয়ে গোটা ছবি তৈরী করার কাজ ও দায়িত্ব যার যার নিজের।
বিখ্যাত ট্রেডার ল্যারি উইলিয়ামসের একটা মোক্ষম কথা বলেছেন - একজন ট্রেডারের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী বই এখনও লেখা হয়নি। বইটা তো সেই ট্রেডার নিজে লিখবে।
অর্থাৎ ল্যারি উইলিয়ামসের মতে একজন ট্রেডারের পক্ষে সবথেকে উপযোগী বইটি তার নিজেরই অভিজ্ঞতার ফসল।
একজন মানুষের মানসিক গঠন , চিন্তা ভাবনা, বিদ্যা বুদ্ধি, সর্বোপরি আর্থিক সংগতি অন্য কোন মানুষের সঙ্গে মেলে না বলেই নিজের ট্রেডিং প্ল্যান নিজেরই করতে হয়।অবশ্যই কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য আছে, সেসব বোঝার জন্য পড়াশোনা। একজন সফল ট্রেডারও সদা পরিবর্তনশীল বাজারের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য পড়াশোনা আর শেখা পাশাপাশি চালিয়ে যায়।
যেকোন সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ সমস্যাটা খাতায় লিখে ফেলা। এতে দেখবেন সমাধানের রাস্তা এবং পদ্ধতি দুটোই অনেকটা হাতের নাগালে চলে আসে।
শেয়ার ট্রেডিং একটা ব্যবসা। যেকোন ব্যবসার মতোই ট্রেডিং ব্যবসায় বিজনেস প্ল্যান তৈরী করা প্রথম ধাপ। আর অবশ্যই, যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্ল্যানটা নিজের হাতে লিখতে হবে। পরিকল্পনাটা আত্মস্থ করা ছাড়াও নিজের হাতে লেখার ফলে কোন ত্রুটি থাকলে সহজেই সংশোধন করা যাবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে সময়োপযোগী করতেও সুবিধা হবে। সবচেয়ে বড় কথা সেই প্ল্যান অনুযায়ী চলতে অসুবিধা হবে না।
Have a plan and trade the plan. এই প্ল্যানের মধ্যে আছে মূলত ট্রেডিং প্ল্যান, ট্রেড ম্যানেজমেন্ট, মানি ম্যানেজমেন্ট, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি সেল্ফ ম্যানেজমেন্ট। আমাদের মূলমন্ত্র - Hope for the best and prepare for the worst
ফান্ডেমেন্টাল চর্চার জন্য ইকোনমিক্স এবং ফিনান্স বোঝার প্রয়োজন আছে। এটা বিনিয়োগের বিষয়।অন্যদিকে ট্রেডরদের মনোবিজ্ঞান আর বিহেভরিয়াল ইকোনমিক্স বিষয় দুটোর উপর ধারণা থাকা জরুরী। আর টেকনিকাল এনালিসিস তো জানতেই হবে।
ট্রেডারদের মূল সমস্যা সময়মত লস বুক করা। লস নেবার অনীহা এর জন্য দায়ী। জেনে বুঝেও কেন লস বুক করা যায় না তার কারণগুলো আলোচনা করছি ভবিষ্যতে ট্রেড ম্যানেজমেন্ট ভালোভাবে করার উদ্দেশ্যে।
প্রত্যেক মানুষেরই কম বেশী অহং বোধ আছে, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভুল স্বীকার না করে একজন মানুষ জেদের বশে অনেক বেশী মাশুল দিতে বাধ্য হয়।
শেয়ার কেনার পর দাম পড়ছে বলে লস বুক করে নেওয়া মানে স্বীকার করা যে আগের কেনার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। অহংবোধে ধাক্কার অনুভূতি কারুর পক্ষেই সুখকর নয়। এই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বহুক্ষেত্রে লস বুক করা হয় না।
আত্মবিশ্বাস আর অহংবোধের মধ্যের ফারাক খুব সুক্ষ। সেই ফারাকটা বজায় না রাখতে পারলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সমস্যা।
প্রকৃতিগত ভাবে একজন মানুষ লাভ করে যে আনন্দ পায়, লোকসান করলে তার দ্বিগুন কষ্ট। পরিভাষায় বলা হয় লস অ্যাভারশন। একদিন না একদিন বাড়বে মনে করে পড়তি দামের শেয়ার ধরে রেখে প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি ঝুঁকি নিচ্ছি। লসে বিক্রি করা অপ্রীতিকর এবং কষ্টের, বলছে কেনাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। লস বুক না করলে এই কষ্টের হাত থেকে রেহাই। এই অভিজ্ঞতার ফলে লাভজনক শেয়ার আরও দ্রুত বিক্রি করে লাভ নেবার প্রবণতা বাড়তে থাকে - না বাবা, লাভ নিয়ে রাখি, পরে এটাও যদি আবার লসে ঢুকে যায়!
আরও একটা বড় সমস্যা আছে। যদি ক্যাপিটাল থাকে, নীচের দামে আরও কিনে অ্যাভারেজ করা হয়। টেকনিক্যালস তখন ভুলে যাচ্ছি - ডাউনট্রেন্ডে কিনছি। আর কেনার টাকা নেই বা টাকা থাকলেও কেনার সাহস নেই, ইতিমধ্যে নজরে থাকা অন্য একটা আপ ট্রেন্ডিং স্টক ব্রেকআউট করে 10-12% বেড়ে গেল। ভালো লাভ করার একটা সুযোগ চলে গেল, আর আগের পজিশনে লস বেড়ে চলেছে। শাঁখের করাত - দুদিক দিয়েই কাটছে।
শেয়ার কেনা মানে কিন্তু শুধু টাকা বিনিয়োগ করা নয়, এর সঙ্গে আরও জড়িয়ে থাকে ঐ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে চিন্তা ভাবনা, চার্ট দেখা। ফলে সময়ও বিনিয়োগ করতে হয়।
এরপর লসে শেয়ারটা বিক্রি করতে গেলে শুধুমাত্র যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, পুরো প্রচেষ্টাটা জলে গেল। এতটা মেনে নেওয়া কঠিন, তার থেকে লসে শেয়ারটা ধরা থাক।
এই প্রবণতার প্রভাবে এবেলা লসে বিক্রি করতে পারলে পরের সুযোগে লস উদ্ধার করার ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে।
ইকোনোমিক্সের ভাষায় এটা সাঙ্ক কস্ট ফ্যালাসি, যার বশবর্তী হয়ে আমরা অযৌক্তিক আচরণ করি।
পরিশেষে একটা ছোট হিসাব করা যাক। 5 লক্ষ টাকা ক্যাপিটালে 20% লোকসান হলে হাতে থাকে 4 লক্ষ টাকা। এবারে ব্রেক-ইভেনে আসতে হলে 25% লাভ করতে হবে। বিজনেস প্ল্যান তৈরী করার সময় এই অঙ্কটাও মাথায় রাখতে হবে।
No comments:
Post a Comment